ওয়ার্ডপ্রেস বর্তমানে পৃথিবীর সেরা এবং শীর্ষস্থানীয় একটি সিএমএস। আর যেটা যতো বেশি জনপ্রিয় হবে বিপরীতে সেটার ততো বেশি ভুল ধারণা তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই ওয়ার্ডপ্রেস নিজেও তার ব্যাতিক্রম নয়। তবে ওয়ার্ডপ্রেসের ক্ষেত্রে এই টপিকটি একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ, এতে ভুল ধারণা জন্মালে ইউজাররা বিভ্রান্তির মধ্যে পরবে। ফলে তারা ভুল প্ল্যাটফর্মে চলে যেতে পারে। এই আর্টিকেলে ওয়ার্ডপ্রেস নিয়ে প্রচলিত এমনই কিছু ভুল ধারণা মাটি খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করবো, যার ফলে আপনি পরিষ্কার ধারণা পেতে পারবেন, ওয়ার্ডপ্রেস আপনার জন্য বা নির্দিষ্ট কাজের জন্য কতোটা উপযোগী!
১. ওয়ার্ডপ্রেস শুধুই একটি ব্লগিং টুল
না, ওয়ার্ডপ্রেস শুধুই একটি ব্লগিং টুল না। ওয়েব বহুল প্রচারিত একটি ভুল ধারণা হচ্ছে, ওয়ার্ডপ্রেস কেবলই একটি ব্লগিং টুল। অর্থাৎ এটি দিয়ে কেবল ব্লগিং করা হয় বা ব্লগ জাতীয় ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়। এখনো অনেকেই এই ধারণাটি পুষে রেখেছেন। আপনি ও যদি এই ধারণা বাঁচিয়ে রাখার একজন হোন, তো ঝেড়ে ফেলুন।
বোল্ড অক্ষরে লিখলাম, “না, ওয়ার্ডপ্রেস শুধুই আর ব্লগিং টুল নেই” – ওয়ার্ডপ্রেস ইউজ করে এখন যেকোনো ওয়েবসাইট বানানো যেতে পারে। হতে পারে সেটা ই-কমার্স ওয়েবসাইট, হতে পারে কোন কমিউনিটি সাইট, বা হতে পারে আপনার বিজনেস ওয়েবসাইট।
এক কথায়, আপনার কল্পনায় যেমন আসতে পারে, ওয়ার্ডপ্রেস দিয়ে ঠিক সেই রকমের ওয়েবসাইটই বানানো সম্ভব! যদি আপনি তেমন কোডিং করতে পারেন। ওয়ার্ডপ্রেস বর্তমানে একটি পাওয়ারফুল ওয়েবসাইট বিল্ডার। আর ভুলে গেলে চলবে না, এই আর্টিকেল লেখার সময় সম্পূর্ণ ইন্টারনেটের প্রায় ৬১.৮% ওয়েবসাইট ওয়ার্ডপ্রেস দ্বারা পরিচালিত।
তো এখন নিজেই অনুধাবন করার চেষ্টা করুন। ওয়ার্ডপ্রেস আসলে ঠিক কতোটা পাওয়ারফুল ও বিশ্বস্ত! খুব বেশি নয় অল্প কিছু পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে। সারাবিশ্বে ওয়ার্ডপ্রেসের জনপ্রিয়তা এবং কার্যকারীতা এত বেশি যে বিবিসি, সনি মিউজিক, এমটিভি নিউজ, দি নিউ ইয়র্কার এমনকি মাইক্রোসফটের মতো জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ওয়েবসাইট ওয়ার্ডপ্রেস দিয়ে ডেভেলপ করিয়েছে। শুধু তাই নয়, Netcraft তাদের এক জরিপে বলে সারাবিশ্বে প্রায় ৪৫৫,০০০,০০০ টি ওয়েবসাইট ওয়ার্ডপ্রেস দ্বারা তৈরি। যা সত্যিই অবিশ্বাস্য।
ওয়ার্ডপ্রেস বর্তমানে শীর্ষ কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম যা সারাবিশ্বের প্রায় ৬১.৮% ওয়েবসাইটকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাহলে খুব সহজেই অনুমান করা যায়, ব্যবহারের দিক থেকে ওয়ার্ডপ্রেসের অবস্থান কি এবং আগামীতে এই প্লাটফরমটি আরো কতটা উন্নত হবে।
আপনি জানেন কি? ওয়ার্ডপ্রেসের জনপ্রিয় উ-কমার্স প্লাগইন দুনিয়ার সবচাইতে বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম! এটি আলাদা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম যেমন- শপিফাই বা ম্যাজেন্টো থেকেও অনেক বড়। তো ছোট বিজনেস ওয়েবসাইট থেকে শুরু করে, বড় বিজনেস ওয়েবসাইট, মেম্বারশিপ ওয়েবসাইট, ব্লগ, ফোরাম, সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইট, অনলাইন শপ; এর সবকিছুই এখন ওয়ার্ডপ্রেস দ্বারা নির্মাণ করা সম্ভব। আপনার শুধু সঠিক প্লাগইনস অ্যান্ড থিমের দরকার পরবে!
২. ওয়ার্ডপ্রেস ফ্রী, তাই এটি নিম্নমানের
“এক সস্তার তিন অবস্থা” বাংলায় এই প্রবাদ বাক্যের কথা নিশ্চই সবার মনে আছে। অনেকেই এটা ওয়ার্ডপ্রেসের ক্ষেত্রেও বোঝাতে চান। অবশ্য তাদের ভুল বলাও যায় না। সত্যিই সস্তা বা ফ্রী জিনিসগুলো তেমন ভালো হয় না।
কিন্তু ওয়ার্ডপ্রেসের ক্ষেত্রে এটি মোটেও প্রযোজ্য নয়। অনেকেই নিজেদের বড় বিজনেস ওয়েবসাইট ওয়ার্ডপ্রেস দিয়ে বানাতে চান না। বরং লাখো টাকা খরচ করে কাস্টম সিএমএস ইউজ করেন। হয়তো তারা মনে মনে ভাবেন, ফ্রী টুল দিয়ে ওয়েবসাইট বানালে হয়তো প্রফেশনাল মনে হবে না। তবে আপনি যদি ওয়ার্ডপ্রেসকে লো কোয়ালিটি আর অনিরাপদ ভেবে থাকেন, তাহলে আপনি অনেক বড় একটু ভুল ধারণা নিয়ে আছেন। অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করবেন, ওয়ার্ডপ্রেস এতোই প্রিমিয়াম জিনিস, তো ডেভেলপার কেন এটাকে বিনামূল্যে দিয়ে দিচ্ছে?
দেখুন, ওয়ার্ডপ্রেস কোন সিঙ্গেল ডেভেলপার দ্বারা নির্মিত নয়, বরং সম্পূর্ণ দুনিয়া জুড়ে লাখ লাখ ডেভেলপার দ্বারা ওয়ার্ডপ্রেস নির্মিত। এর কোড সম্পূর্ণ ওপেন সোর্স, মানে যে কেউ চাইলে এর কোডের কোয়ালিটি টেস্ট করতে পারেন! ওয়ার্ডপ্রেস তৈরিতে ব্যবহৃত কোড পাঁথরের মতোই মজবুত, ডেভেলপার ফ্রেন্ডলি, সকলের জন্য উন্মুক্ত, এবং ফ্রী! আপনার ধারণা, এর কোড ওপেন সোর্স, মানে যেকোনো হ্যাকার এর কোড স্টাডি করতে পারবে। তারপরে এর দুর্বলতা খুঁজে বের করে হ্যাকিং অ্যাটাক চালাতে পারবে।
এক্ষেত্রে কিছু জিনিষ আপনাকে মনে রাখতে হবে। এটি শুধু ওয়ার্ডপ্রেসের ক্ষেত্রেই নয়, বরং দুনিয়ার যেকোনো ওয়েবসাইটের ওপরে ম্যালওয়্যার বা হ্যাকিং অ্যাটাক চলতে পারে। আর এর জন্য ওয়ার্ডপ্রেসের অনেক সিকিউরিটি প্লাগইন ও তৃতীয়পক্ষ ফায়ারওয়াল সার্ভিস রয়েছে। যারা আপনাকে আপনার ওয়েবসাইটের নানান অ্যাটাক মনিটর করবে সর্বদা। পাশপাশি কোন এটাক স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেটিক মোকাবিলা করার সক্ষমতাও তাদের আছে।
আপনি ওয়ার্ডপ্রেসে সাইট রান করান বা নাই করান, আপনাকে তো আলাদা সিকিউরিটি ব্যবস্থা রাখতেই হবে। যেমন: ক্লাউডফ্লেয়ার বা সিকিউরি সার্ভিস ইউজ করা! আরেকদিকে যারা বিজনেস ওয়েবসাইটে ওয়ার্ডপ্রেস ইউজ করতে চান না বা নিজেদের আরো বেশি প্রফেশনাল ফিল করানোর জন্য কাস্টম সিএমএস ব্যবহার করেন,
তারা জেনে অবাক হবেন যে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ড যেমন- CNN, Microsoft, Adobe, The New York Times — এরা নিজেরাও ওয়ার্ডপ্রেস ইউজ করতে দ্বিধা বোধ করে না। যা এই আর্টিকেলের প্রথমেই বলেছি। তার বিশ্বের এত বড় বড় জায়ান্ট কোম্পানি হয়ে ওয়ার্ডপ্রেস পছন্দ করার ক্ষেত্রে নিশ্চই ভুল কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি।
৩. ওয়ার্ডপ্রেস শুধুই নতুনদের জন্য
ওয়ার্ডপ্রেস অনেক সহজ একটি ওয়েবসাইট বিল্ডার। যার ফলে নতুন যার ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শিখছেন, তাদের জন্য এটি প্রথম পছন্দ। এজন্য অনেকেই মনে করেন এটি বাচ্চাদের জন্য তৈরি। অর্থাৎ, যারা কেবল ওয়েবসাইট বিল্ড করতে শিখছেন তাদের জন্য। নিজেকে অনেক বড় মনে করা ডেভেলপাররা অনেকেই ওয়ার্ডপ্রেসকে বিগেনার টুল বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টি বেশি পরিলক্ষিত হয়।
কারণ হিসেবে তারা বলে, ওয়ার্ডপ্রেস দ্বারা ওয়েবসাইট বানাতে হলে আপনাকে এইচটিএমএল, সিএসএস, জাভা স্ক্রিপ্ট এসবের কিছুই শিখতে হয় না। ব্যাপারি কিন্তু সম্পূর্ণ এরকম নয়। হ্যাঁ, ওয়ার্ডপ্রেস মারাত্মক পরিমাণে বিগেইনার ফ্রেন্ডলি। কিন্তু পাশাপাশি এটাকে কর্পোরেশন, বিজনেস, এবং ডেভেলপাররা ইউজ করেন।
ওয়ার্ডপ্রেস যেমন বিগেনারদের জন্য স্বর্গরাজ্য, ঠিক তেমনি অ্যাডভান্স লেভেল ইউজারদের জন্যও এতে রয়েছে অনেক কিছু। নতুন ইউজাররা কোন ঝামেলা ছাড়াই প্রথম ওয়েবসাইট নিজে থেকে তৈরি করতে পারেন। অপরদিকে অ্যাডভান্স ইউজারগণ সাইট আরো ফ্লেক্সিবল তৈরি করেন, থিম ও প্লাগইন ডেভেলপ করেন!
৪. সব ওয়ার্ডপ্রেস সাইট দেখতে একই, পার্থক্য নেই!
অনেকের মতে সকল ওয়ার্ডপ্রেস সাইট দেখতে একই রকমের। ওয়ার্ডপ্রেস সাইটটির ফ্রন্টএন্ড দেখতে কেমন হবে সেটা নির্ভর করে সাইটের থিমের উপরে। ওয়ার্ডপ্রেসের জন্য অনেক ফ্রি থিম রয়েছে, এদের মধ্যে কিছু ফ্রী থিম খুবই জনপ্রিয়। যার ফলে একই থিম অনেককেই ব্যবহার করতে দেখা যায়। সুতরাং সেই ধরণের কোন থিম ইউজ করলে, আপনার সাইটের ডিজাইন বাকিদের মতোই দেখতে লাগতে পারে।
তবে হ্যাঁ, আপনি চাইলে অল্প কিছু টাকা খরচ করে আপনার সাইটের জন্য প্রিমিয়াম থিম কিনতে পারেন, যা দেখতে অনেকটা ইউনিক এবং আপনি আপনার নিজের মতো করে কাস্টোমাইজ করে নিতে পারবেন। থিম ফরেস্ট কিংবা টেম্পল মনস্টারের মত বড় বড় কোম্পানি এসব প্রিমিয়াম থিম প্রোভাইড করে থাকে।
আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে প্রিমিয়াম কোয়ালিটির ওয়ার্ডপ্রেস থিমগুলো অল্প দামে বিক্রি করে থাকি। যার একটি থিম আপনি একাধিক ওয়েবসাইটে ব্যবহার করতে পারবেন। আমাদের থিমগুলো দেখতে এখানে ক্লি করুন।
তাছাড়া ওয়ার্ডপ্রেসের জন্য অনেক ভিজুয়াল পেজ বিল্ডার প্লাগইন রয়েছে। যেগুলো ইউজ করে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা মতো আপনার সাইট ডিজাইন করতে পারবেনভ আর মজার ব্যাপার হচ্ছে এর জন্য আপনাকে এক লাইন ও কোড জানতে হবে না।
৫. ওয়ার্ডপ্রেস যদি হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যায়?
অনেকেই ওয়ার্ডপ্রেসের ভবিষ্যাৎ নিয়ে শঙ্কিত। তারা ওপেন সোর্স সফটওয়্যার কিভাবে কাজ করে, এই ব্যাপারে ভালো ধারণা রাখেন না। কিন্তু মনে মনে ভয় পুষে রেখেছেন: যদি ওয়ার্ডপ্রেস হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায় কোন দিন?
একটা কথা মনে রাখুন, যা কি না এই আর্টিকেলের শুরুর দিকেও বলেছি। ওয়ার্ডপ্রেস কোন একজন সিঙ্গেল ডেভেলপার দ্বারা নির্মিত নয়। বরং এটি সম্পূর্ণ দুনিয়ার বিশাল এক প্যাশনেট ডেভেলপার গ্রুপ দ্বারা নির্মিত। এর ট্রেডমার্ক প্রটেক্টেড এবং ওয়ার্ডপ্রেস ফাউন্ডেশন নামক এক নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন হচ্ছে এর মালিক।
হাজারো এবং লাখো কোম্পানি রয়েছে যারা ওয়ার্ডপ্রেস রিলেটেড প্রোডাক্ট সেল করে। অনেক কোম্পানি সরাসরি ওয়ার্ডপ্রেস কমিউনিটির সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। ওয়ার্ডপ্রেস কোন এক কোম্পানি বা পারসন বা গ্রুপের উপরে নির্ভর করে না, যে হঠাৎ করে এটি গায়েব হয়ে যাবে।
এটি গোটা দুনিয়ার লাখো কোটি মানুষের উপরে নির্ভরশীল। ওয়ার্ডপ্রেস নিজে থেকে ফ্রী প্ল্যাটফর্ম হলেও প্রতি মাসে এটি থেকে নানান কোম্পানি মিলিয়ন ও বিলিয়ন ইউএস ডলার রেভিনিউ জেনারেট করে। তো কেউ নিজের সোনার ডিম পারা হাঁসকে কেন হারিয়ে যেতে দেবে বলুন।
তো সবশেষে আপনি যদি আলাদা কোন প্ল্যাটফর্মের কথা চিন্তা করেন যেমন: গুগল ব্লগার ; হ্যাঁ, গুগল যেকোনো মুহূর্তে চাইলে এটাকে বন্ধ করে দিতে পারে। যেমন তারা তাদের গুগল প্লাস বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ওয়ার্ডপ্রেসের ক্ষেত্রে এমন কোন ঝুঁকি নেই। সুতরাং আপনি নিশ্চিন্তে ওয়েবসাইট তৈরির এই জনপ্রিয় প্লাটফরম ব্যবহার করতে পারেন।
ওয়েব ডিজাইন, ডেভেলপমেন্টে এবং ফ্রিল্যান্সিং শিখতে আমাদের ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিন। আমরা আছি ইউটিউবেও। আমাদের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন এখান থেকে।